নাথসাহিত্য

নাথসাহিত্য

নাথসাহিত্য

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে নাথধর্মের কাহিনি অবলম্বনে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য নাথসাহিত্য নামে পরিচিত। এ দেশে প্রাচীনকাল থেকে শিব উপাসক এক শ্রেণির যােগী সম্প্রদায় ছিল, তাদের আচরিত ধর্মের নাম নাথধর্ম। হাজার বছর আগে ভারত জুড়ে এ সম্প্রদায়ের খ্যাতি ছিল। তাদের গতিবিধির ব্যাপকতার জন্য সারা ভারতে তাঁদের কীর্তি ও কাহিনি ছড়িয়ে আছে। নাথ অর্থ প্রভু, দীক্ষান্তে এই নাথ পদবী তাঁরা নামের শেষে যুক্ত করতেন । অলৌকিক ক্ষমতায় তাঁরা ছিলেন সিদ্ধ। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে শৈবধর্ম মিশে এ ধর্মমতের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। বিশেষ সাধনপ্রক্রিয়া দ্বারা মােক্ষ লাভ করা এ ধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্য। 

শিবকে তারা আদিগুরু বলে বিবেচনা করেন। তাই শিব হলেন আদিনাথ। তাঁর শিষ্য মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথ। এই মীননাথই নাথধামের প্রতিষ্ঠাতা। মীননাথের। শিষ্য গােরক্ষনাথ। শিবের অপর শিষ্য হাড়িপা বা জালন্ধরিপা এবং হাড়িপার শিষ্য গােরক্ষনাথ। শিবের অপর শিষ্য হাড়িপা বা জালন্ধরিপা এবং হাড়িপার শিষ্য। হলেন কানুপা বা কাহ্নপাদ। এই চারজন সিদ্ধাচার্যের মাহাত্মসূচক অলৌকিক কাহিনি অবলম্বনেই নাথসাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে। জ মহম্মদ শহীদুলাহ মীননাথ বা মৎস্যন্দ্রনাথের সময় সপ্তম শতকের মধ্যভাগে মনে করেন। অবশ্য এ সম্পর্কে মতানৈক্য থাকলেও দশম-একাদশ শতকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাথাচার্যদের অবির্ভাব ঘটেছিল বলে অনুমান করা হয়। 

এ সময়ই নাথধর্ম বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত। অষ্টাদশ শতকের আগে লেখা নাথসাহিত্যের কোন পুথি পাওয়া যায়নি। নাথসাহিত্যের কাল সম্পর্কে ড. আহমদ শরীফ মন্তব্য করেছেন, 'আদিনাথ-মীননাথ কাহিনির শুরু আট শতকে এবং মীননাথ-গােরক্ষনাথ কিংবা হাড়িপা-কানুপার কাহিনির উদ্ভব তার পরে পরেই। এঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকলেও মাণিকচাঁদ ময়নামতী গােপীচাদ কাহিনি দশ শতকের আগেকার নয়। অতএব, আট-দশ শতকে কায়া সাধনার রূপক কাহিনি মুখে মুখে চালু ছিল। মােল শতকের মীননাথ-গােরক্ষনাথ কাহিনি 'গােরক্ষবিজয়' কাপে লিখিত রূপ পায়। গােপীচাঁদ গানও সতের আঠার শতকে লিখিত পাঁচালীতে স্থিতি পায়, কিন্তু মাণিক-ময়নামতী গাঁথা লােকসাহিত্য রূপে বিশ শতকেই সংগৃহীত ও মুদ্রিত হয়। মৌখিক নাথসাহিত্যের ভাষা আঞ্চলিক ও আধুনিক।'নাথসাহিত্যে আদিনাথ শিব, পার্বতী, মীননাথ, গােরক্ষনাথ, হাড়িপা, কানুপা, ময়নামতী ও গােপীচন্দ্রের কাহিনি স্থান পেয়েছে। 

এ সব কাহিনি দু ভাবে বিভক্ত। একটিতে আছে সিদ্ধাদের ইতিহাসে এবং গােরক্ষনাথ কর্তক মীননাথকে নারীমােহ থেকে উদ্ধার; অপরভাগে আছে রানী ময়নামতী ও তার পুত্র গােপীচন্দ্র বা | গােবিন্দচন্দ্রের কাহিনি। প্রথমটি গােরক্ষবিজয়, অপরটি ময়নামতী বা গােপীচন্দের গান নাম পরিচিত। প্রথমটিতে ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠা প্রধান্য পেয়েছে। অপরটিতে ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার চেয়ে কাব্যগুণ প্রাধান্য লাভ করেছে। 

 নাথসাহিত্যের কবিগণঃ  নাথধর্ম সংক্রান্ত গল্পকাহিনি নিয়ে যেসব সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত লােকচক্ষুর অন্তরালেই ছিল। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার স্যার জর্জ গ্ৰীয়ার্সন রংপুর থেকৈ সংগৃহীত একটি গীতিকা 'মাণিকচন্দ্র রাজার গান' নাম দিয়ে এশিয়াটিক সােসাইটির জার্নালে প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে উত্তর ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল। থেকে 'ময়নামতীর গান', 'গােপীচন্দ্রের গান', 'গােপীচন্দ্রের সন্ন্যাস' ইত্যাদি বিভিন্ন নামে একই কাহিনিভিত্তিক পুথি আবিষ্কৃত হয়েছে। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ শেখ ফয়জুল্লাকৃত ‘গােরক্ষবিজয়' কাব্যের পুথি আবিষ্কার করে প্রকাশ করেছেন। 

গােরক্ষনাথ-মীননাথের কাহিনি অবলম্বনে রচিত যে সব কাব্য সম্পাদিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে সেগুলাে হল । 

  1. আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সম্পাদিত কবি শেখ ফয়জুল্লার ‘গােরক্ষবিজয়', 
  2. ড, নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত কৰি শ্যামদাস সেনের 'মীনচেতন' এবং 
  3. ড. পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত কবি ভীম সেনের 'গাের্থবিজয়'। এই তিনটি কাব্যের কবিরা স্বতন্ত্র না একই ব্যক্তি - এ সম্পর্কে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতবিরােধ রয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন